সূরা আর রহমান ( আয়াত নং - ৩২ এর তাফসীর )
فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ
মুফতী তাকী উসমানী
সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নি‘আমতকে অস্বীকার করবে?
তাফসীরে মাআ’রিফুল কুরআনঃ
( এ পর্যন্ত যেসব অবদানের কথা তোমরা শুনলে, তোমাদের উচিত তওহীদ ও ইবাদতের মাধ্যমে এগুলোর কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং কুফর ও গোনাহের মাধ্যমে অকৃভজ্ঞতা না করা। কেননা, এ জগত ধ্বংস হওয়ার পর আরেকটি জগৎ আসবে। সেখানে ঈমান ও কুফরের কারণে প্রতিদান ও শাস্তি দেওয়া হবে। পরবর্তী আয়াতসমূহে তাই বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে) ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই (অর্থাৎ জিন ও মানব) ধ্বংস হয়ে যাবে এবং (একমাত্র) আপনার পালনকর্তার মহিমময় ও মহানুভব সত্তা অবশিষ্ট থাকবে। (উদ্দেশ্য জিন ও মানবকে হুঁশিয়ার করা। তারা ভূপৃষ্ঠে বসবাস করে। তাই বিশেষভাবে ভূপৃষ্ঠের সবকিছু ধ্বংস হবে বলা হয়েছে। এতে জরুরী হয় না যে, অন্য কোন বস্তু ধ্বংস হবে না। এখানে আল্লাহ্ তা’আলার দু’টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। মহিমময় ও মহানুভব। প্রথমটি সত্তাগত ও দ্বিতীয়টি আপেক্ষিক। এর সারমর্ম এই যে, অনেক মহিমান্বিত ব্যক্তি অপরের অবস্থার প্রতি দুক্পাত করে না। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার মহামহিম হওয়া সত্ত্বেও বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ ও কৃপা করেন। পৃথিবী ধ্বংস হওয়া ও এরপর প্রতিদান ও শাস্তিদানের সংবাদ দেওয়া মানুষকে ঈমানরূপ ধন দান করার নামান্তর। তাই এটা একটা বড় অবদান। সেমতে বলা হয়েছে :) অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? (তিনি এমন মহিমময় যে,) নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সবাই তাঁরই কাছে (নিজ নিজ প্রয়োজন) প্রার্থনা করে। (ভূমণ্ডলে বসবাসকারীদের প্রয়োজন বর্ণনা সাপেক্ষ নয়। নভোমণ্ডলে বসবাসকারীরা পানাহার না করলেও দয়া ও অনুকম্পার মুখাপেক্ষী। অতএব আল্লাহ্ তা’আলার মহানুভবতা প্রকারান্তরে বর্ণনা করা হচ্ছেঃ) তিনি সর্বদাই, কোন-না-কোন কাজে রত থাকেন। (এর অর্থ এরূপ নয় যে, কাজ করা তাঁর সত্তার জন্য অপরিহার্য। বরং অর্থ এই যে, বিশ্বচরাচরে যত কাজ হচ্ছে, সবই তাঁরই কাজ। তাঁর অনুগ্রহ এবং অনুকম্পাও এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মহিমময় হওয়া সত্ত্বেও এরূপ অনুগ্রহ ও কৃপা করাও একটি মহান অবদান)। অতএব হে মানব ও জিন! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? (অতঃপর আবার পৃথিবী ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তোমরা মনে করো না যে, ধ্বংসের পর শাস্তি ও প্রতিদান হবে না। বরং আমি তোমাদেরকে পুনরায় জীবিত করব এবং শাস্তি ও প্রতিদান দেব। বলা হচ্ছে: ) হে মানব ও জিন! আমি শীঘ্রই তোমাদের (হিসাব-নিকাশের) জন্য কর্মমুক্ত হয়ে যাব। (অর্থাৎ হিসাব কিতাব নেব। রূপক ও আতিশয্যের অর্থে একেই কর্মমুক্ত হওয়া বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। আতিশয্য এভাবে বোঝা যায় যে, মানুষ সব কাজ থেকে মুক্ত হয়ে কোন কাজে হাত দিলে একে পূর্ণ মনোনিবেশ বলে গণ্য করা হয়। মানুষের বুঝবার জন্য একথা বলা হয়েছে। নতুবা আল্লাহ্ তা’আলার শান এই যে, তাঁর এক কাজ অন্য কাজের জন্য বাঁধা হয়ে যায় না। তিনি যে কাজে মনোবিবেশ করেন পূর্ণরূপেই মনোনিবেশ করেন। আল্লাহর কাজে অসম্পূর্ণ মনোনিবেশের সম্ভাবনা নেই। এই হিসাব নিকাশের সংবাদ দেওয়াও একটি মহান অবদান। তাই বলা হচ্ছেঃ ) হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (হিসাব-নিকাশের সময় কারও পলায়ন করারও সম্ভাবনা নেই। তাই ইরশাদ হচ্ছে : ) হে জিন ও মানবকুল! নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সীমা অতিক্রম করে বাইরে চলে যাওয়া যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায়, তবে ( আমিও দেখি,) তোমরা চলে যাও, (কিন্তু) শক্তি ব্যতীত তোমরা চলে যেতে পারবে না। (শক্তি তোমাদের নেই। কাজেই চলে যাওয়াও সম্ভবপর নয়। কিয়ামতেও তদ্রপ হবে। বরং সেখানে অক্ষমতা আরও বেশী হবে। মোটকথা, পলায়ন করার সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়টি বলে দেওয়াও হিদায়তের কারণ এবং একটি মহান অবদান।) অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (উপরে যেমন হিসাব-নিকাশের সময় তাদের অক্ষমতা বর্ণনা করা হয়েছে, তেমনি অতঃপর আযাবের সময় তাদের অক্ষমতা উল্লেখ করা হচ্ছে। অর্থাৎ হে জিন ও মানব অপরাধীরা!) তোমাদের প্রতি (কিয়ামতের দিন ) অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং ধূম্রকুঞ্জ ছাড়া হবে। অতঃপর তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না। একথা বলাও হিদায়তের উপায় হওয়ার কারণে একটি মহান অবদান)। অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ( এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? (যখন হিসাব-নিকাশ নেওয়া ও এতদসঙ্গে তোমাদের অক্ষমতার কথা জানা গেল, তখন কিয়ামতের দিন প্রতিদান ও শাস্তির বাস্তবতা প্রমাণিত হয়ে গেল। সুতরাং ) যখন (কিয়ামত আসবে এবং) আকাশ বিদীর্ণ হবে, তখন হয়ে যাবে রক্তিমাভ, লাল চামড়ার মত। (ক্রোধের সময় চেহারা রক্তিমাভ হয়ে যায়। ক্রোধের আলামত হিসাবেই সম্ভবত এই রং হবে। এই সংবাদ দেওয়াও একটি মহান অবদান)। অতএব হে জিন ও মনিব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদনিকে অস্বীকার করবে? অতঃপর বলা হচ্ছে যে, অপরাধী ও অপরাধের পরিচয় আল্লাহ্ তা’আলার জানা আছে, কিন্তু ফেরেশতারা অপরাধীদেরকে কিভাবে চিনবে? এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে :) অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা থেকে। (কারণ তাদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ও চক্ষু নীলাভ হবে। যেমন অন্য আয়াতে আছে وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ এবং وَنَحْشُرُ الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا অতঃপর তাদের কেশাগ্র ও পা ধরে টেনে নেওয়া হবে। এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে অর্থাৎ আমল অনুযায়ী কারও কেশাগ্র এবং কারও পা ধরা হবে অথবা কখনও কেশাগ্র এবং কখনও পা ধরা হবে। এই সংবাদ দেওয়াও একটি অবদান)। অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? এটাই সেই জাহান্নাম, যাকে অপরাধীরা মিথ্যা বলতো। তারা জাহান্নাম ও ফুটন্ত পানির মাঝখানে প্রদক্ষিণ করবে। (অর্থাৎ কখনও অগ্নির আযাব এবং কখনও ফুটন্ত পানির আযাব হবে। এই সংবাদ দেওয়াও একটি অবদান) অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে!
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
এর অর্থ এই যে, ভূপৃষ্ঠে যত জিন ও মানব আছে, তারা সবাই ধ্বংসশীল। এই সূরায় জিন ও মানবকেই সম্বোধন করা হয়েছে। তাই আলোচ্য আয়াতে বিশেষভাবে তাদের প্রসঙ্গই উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে জরুরী হয় না যে, আকাশ ও আকাশস্থিত সৃষ্ট বস্তু ধ্বংসশীল নয়। কেননা অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ব্যাপক অর্থবোধক ভাষায় সমগ্র সৃষ্টিজগতের ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয়টিও ব্যক্ত করেছেন। বলা হয়েছে : كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ
وَجْهُ رَبِّكَ
অধিকাংশ তফসীরবিদের মতে এ বলে আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা এবং وَجْهُ শব্দের সম্বোধন সর্বনাম দ্বারা রসুলুল্লাহ্ (সা)-কে বোঝানো হয়েছে। এটা সাইয়্যেদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)-র একটি বিশেষ সম্মান। প্রশংসার স্থলে কোথাও তাঁকে عبدهُ এবং কোথাও رَبِّكَ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
প্রসিদ্ধ তফসীর অনুযায়ী আয়াতের অর্থ এই যে, জিন ও মানবসহ আকাশ ও পৃথি বীতে যা কিছু আছে সবই ধ্বংসশীল। অক্ষয় হয়ে থাকবে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা।
ধ্বংসশীল হওয়ার অর্থ এরূপও হতে পারে যে, এসব বস্তু, এখনও সত্তাগতভাবে ধ্বংস শীল। এগুলোর মধ্যে চিরস্থায়ী হওয়ার যোগ্যতাই নেই। আরেক অর্থ এরূপ হতে পারে যে, কিয়ামতের দিন এগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
কোন তফসীরবিদ وَجْهُ رَبِّكَ – এর তফসীর এরূপ করেছেন যে, সমগ্র সৃষ্ট জগতের মধ্যে একমাত্র সেই বস্তুই স্থায়ী, যা আল্লাহ্ তা’আলার দিকে আছে। এতে শামিল আছে আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা এবং মানুষের সেসব কর্ম ও অবস্থা, যা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর সারমর্ম এই যে, মানব জিন ও ফেরেশতা যে কাজ আল্লাহর জন্য করে, সেই কাজও চিরস্থায়ী, অক্ষয়। তা কোন সময় ধ্বংস হবে না। -(মাযহারী, কুরতুবী, রূহুল মা’আনী)
কোরআন পাকের নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায় :مَا عِنْدَكُمْ يَنْفَدُ وَمَا عِنْدَ اللَّهِ بَاقٍ —অর্থাৎ তোমাদের কাছে যা কিছু অর্থ-সম্পদ, শক্তি-সামর্থ্য, সুখ-কষ্ট অথবা ভালবাসা ও শত্রুতা আছে, সব নিঃশেষ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে, তা অবশিষ্ট থাকবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের যেসব কর্ম ও অবস্থা আছে, সেগুলো ধ্বংস হবে না।
ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
অর্থাৎ সেই পালনকর্তা মহিমামণ্ডিত এবং মহানুভবও। মহানুভব হওয়ার এক অর্থ এই যে, প্রকৃতপক্ষে সম্মান বলতে যা কিছু আছে, এ সবেরই যোগ্য একমাত্র তিনিই। আরেক অর্থ এই যে, তিনি মহিমময় হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের মত নন যে, অন্যের বিশেষত দরিদ্রের প্রতি ভ্রূক্ষেপও করবেন না। বরং তিনি অকল্পনীয় সম্মান ও শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সৃষ্ট জীবেরও সম্মান বর্ধন করেন। তাদেরকে অস্তিত্ব দানের পর নানাবিধ অবদান দ্বারা ভূষিত করেন এবং তাদের প্রার্থনা ও দোয়া শুনেন। পরবর্তী আয়াতে এই দ্বিতীয় অর্থের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ বাক্যটি আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ গুণাবলীর অন্যতম। এই শব্দগুলো উল্লেখ করে যে দোয়াই করা হয়, কবুল হয়। তিরমিযী, নাসায়ী ও মসনদে আহমদের রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ أَلِظُّوا بِيَا ذَا الْجِلَالِ وَالْإِكْرَامِ —অর্থাৎ তোমরা “ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম” বলে দোয়া করো। (কারণ, এটা কবুল হওয়ার পক্ষে সহায়ক)।--মাযহারী
يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ
অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্ট বস্তু আল্লাহ্ তা’আলার মুখাপেক্ষী এবং তার কাছেই প্রয়োজনাদি যাচ্ঞা করেন। পৃথিবীর অধিবাসীরা তাদের রিযিক, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সুখ-শান্তি, পরকালে ক্ষমা, রহমত ও জান্নাত প্রার্থনা করে এবং আকাশের অধিবাসীরা যদিও পানাহার করে না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ও কৃপার তারাও মুখাপেক্ষী। كُلَّ يَوْمٍ শব্দটি يَسْأَلُ বাক্যের طرف –অর্থ এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার কাছে তাদের এই যাচ্ঞা ও প্রার্থনা প্রতিনিয়তই অব্যাহত থাকে। এর সারমর্ম এই যে, সমগ্র সৃষ্ট বস্তু বিভিন্ন ভূখণ্ডে ও বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কাছে নিজেদের অভাব-অনটন সর্বক্ষণ পেশ করতে থাকে। বলা বাহুল্য, পৃথিবীস্থ ও আকাশস্থ সমগ্র সৃষ্ট জীব ও তাদের প্রত্যেকের অসংখ্য অভাব-অনটন আছে। তাও আবার প্রতি মুহূর্তে ও প্রতি পলে পেশ করা হচ্ছে। এগুলো এই মহিমময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ ব্যতীত আর কে শুনতে পারে এবং পূর্ণ করতে পারে? তাই كُلَّ يَوْمٍ এর সাথে هُوَ فِي شَأْنٍ ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ সর্বদা ও সর্বক্ষণ আল্লাহ্ তা’আলার একটি বিশেষ শান ও অবস্থা থাকে। তিনি কাউকে জীবনদান করেন, কারও মৃত্যু ঘটান, কাউকে সম্মানিত করেন। কাউকে লাঞ্ছিত করেন কোন সুস্থকে অসুস্থ, কোন অসুস্থকে সুস্থ করেন। কোন বিপদগ্রস্তকে বিপদ থেকে মুক্তি দেন, কোন ব্যথিত ও ক্রন্দনকারীর মুখে হাসি ফুটান, কোন প্রার্থনাকারীকে প্রার্থিত বস্তু দান করেন। কারও পাপ মার্জনা করে তাকে জান্নাতের যোগ্য করে দেন। কোন জাতিকে সমুন্নত ও ক্ষমতায় আসীন করে দেন এবং কোন জাতিকে অধঃপতিত ও লাঞ্ছিত করে দেন। মোটকথা, প্রতিমুহূর্তে, প্রতি পলে আল্লাহ্ তা’আলার একটি বিশেষ শান থাকে।
ثقَلَانِ - سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَ الثَّقَلَانِ
শব্দটি ثقَل এর দ্বি-বচন। যে বস্তুর ওজন ও মূল্যমান সুবিদিত, আরবী ভাষায় তাকে ثقَل বলা হয়। এখানে মানব ও জিন জাতিদ্বয় বোঝানো হয়েছে। এক হাদীসে রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেনঃ إِنِّي تَارِكٌ فِيكُمُ الثِّقْلَيْنِ অর্থাৎ আমি দুটি ওজনবিশিষ্ট ও সম্মানার্হ বিষয় ছেড়ে যাচ্ছি। এগুলো তোমাদের জন্য সৎপথের দিশারী হয়ে থাকবে। কোন কোন রেওয়ায়েতে كِتَابُ اللهِ وعترتي বলে এবং কোন কোন রেওয়ায়েতেكِتَابُ اللهِ وسنتي বলে উল্লিখিত বিষয় দুটি বর্ণিত হচ্ছে। উভয়ের সারমর্ম এক। কেননা, عترتي বলে রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বংশগত ও আধ্যাত্মিক উভয় প্রকার সন্তান-সন্ততি বোঝানো হয়েছে। কাজেই সাহাবায়ে কিরামও এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসের অর্থ এই যে, রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওফাতের পর দুটি বিষয় মুসলমানদের হিদায়াত ও সংশোধনের উপায় হবে—একটি আল্লাহর কিতাব কোরআন ও অপরটি সাহাবায়ে কিরাম ও তাঁদের কর্মপদ্ধতি। যে হাদীসে ‘সুন্নত’ শব্দ ব্যবহাত হয়েছে, তার সারমর্ম হচ্ছে, রসূলুল্লাহ্ (সা) এর শিক্ষা, যা সাহাবায়ে কিরামের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে পৌঁছেছে।
মোটকথা, এই হাদীসে ثِّقْلَيْنِ বলে দুটি ওজনবিশিষ্ট ও সম্মানার্হ বিষয় বোঝানো হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে জিন ও মানব জাতিকে এই অর্থের দিকে দিয়েই ثِّقْلَيْنِ বলা হয়েছে। কারণ পৃথিবীতে যত প্রাণী বসবাস করে, তাদের মধ্যে জিন ও মানব সর্বধিক ওজন বিশিষ্ট ও সম্মানার্হ। سَنَفْرُغُ শব্দটি فراغ থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ কর্মমুক্ত হওয়া। অভিধানে فراغ বিপরীত শব্দ হচ্ছে شغل অর্থাৎ কর্মব্যস্ততা فراغ শব্দ থেকে দুটি বিষয় বোঝা যায়—এক. পূর্বে কোন কাজে ব্যস্ত থাকা এবং দুই, এখন সেই কাজ সমাপ্ত করে কর্মমুক্ত হওয়া। উভয় বিষয় সৃষ্ট জীবের মধ্যে প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। মানুষ কোন সময় এক কাজে ব্যস্ত থাকে এরপর তা থেকে মুক্ত হয়ে অবসর লাভ করে। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা উভয় বিষয় থেকে মুক্ত ও পবিত্র তাঁর এক কাজ অন্য কাজের জন্য বাধা হয় না এবং তিনি মানুষের ন্যায় কাজ থেকে অবসর লাভ করেন না।
তাই আয়াতে سَنَفْرُغُ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী একথা বলা হয়েছে। কোন কাজের গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্য বলা হয়। আমি এই কাজের জন্য অবসর লাভ করেছি। অর্থাৎ এখন এ কাজেই পুরাপুরি মনোনিবেশ করব। কোন কাজে পূর্ণ মনোযোগ ব্যয় করাকে বাক পদ্ধতিতে এভাবে প্রকাশ করা হয়। তার তো এছাড়া কোন কাজ নেই।
এর আগের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি সৃষ্ট জীব আল্লাহর কাছে তাদের অভাব-অনটন পেশ করে এবং আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রার্থনা পূর্ণ করার ব্যাপারে সর্বদাই এক বিশেষ শানে থাকেন। আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আবেদন ও আবেদন মঞ্জুর করা সম্পর্কিত সব কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কাজ কেবল একটি থাকবে এবং শানও একটি হবে। অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ ও ইনসাফ সহকারে ফয়সালা প্রদান। ---( রাহুল মা’আনী )
يَامَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوا لَا تَنْفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ
পূর্ববর্তী আয়াতে জিন ও মানবকে ثقلين শব্দ দ্বারা সম্বোধন করে বলা হয়েছিল যে, কিয়ামতের দিন একটিই কাজ হবে। অর্থাৎ সকল জিন ও মানবের কাজকর্ম পরীক্ষা হবে এবং প্রতিটি কাজের প্রতিদান ও শাস্তি দেওয়া হবে। আলোচ্য আয়াতে একথা বলা উদ্দেশ্য যে, প্রতিদান দিবসের উপস্থিতি এবং হিসাব-নিকাশ থেকে কেউ পলায়ন করতে পারবে না। মৃত্যুর কবল থেকে অথবা কিয়ামতের হিসাব থেকে গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই। এই আয়াতে ثقلان এর পরিবর্তে জিন ও মানবের প্রকাশ্য নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং জিনকে অগ্রে রাখা হয়েছে। এতে সম্ভবত ইঙ্গিত আছে যে, আকাশ ও পৃথিবীর প্রান্ত অতিক্রম করতে হলে বিরাট শক্তি ও সামর্থ্য দরকার। জিন জাতিকে আল্লাহ তা’আলা এ ধরনের কাজের শক্তি মানুষের চাইতে বেশী দিয়েছেন। তাই জিনকে অগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতের অর্থ এইঃ হে জিন ও মানবকুল, তোমরা যদি মনে কর যে, তোমরা কোথাও পালিয়ে গিয়ে মালাকুল-মওতের কবল থেকে গা বাঁচিয়ে যাবে অথবা হাশরের ময়দান থেকে পালিয়ে গিয়ে হিসাব-নিকাশের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, তবে এস, শক্তি পরীক্ষা করে দেখ। যদি আকাশ ও পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করার সামর্থ্য তোমাদের থাকে, তবে অতিক্রম করে দেখাও। এটা সহজ কাজ নয়। এর জন্য অসাধারণ শক্তি ও সামর্থ্য দরকার। জিন ও মানব কারও এরূপ শক্তি নেই। এখানে আকাশ ও পৃথিবীর প্রান্ত অতিক্রম করার সম্ভাব্যতা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। বরং অসম্ভবকে সম্ভব ধরে নেওয়ার পর্যায়ে তাদের অক্ষমতা ব্যক্ত করা লক্ষ্য।
আয়াতে যদি মৃত্যু থেকে পলায়ন বোঝানো হয়ে থাকে, তবে এই দুনিয়াই এর দৃষ্টান্ত। এখানে ভূপৃষ্ঠ থকে আকাশ পর্যন্ত সীমা ডিঙ্গিয়ে বাইরে চলে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভবপর নয়। এসব সীমা ডিঙানোর উল্লেখও মানুষের ধারণা অনুযায়ী করা হয়েছে। নতুবা যদি ধরে নেওয়া হয় যে, কেউ আকাশের সীমানা ডিঙ্গিয়ে বাইরে চলে গেল, তবে তাও আল্লাহ্ কুদরতের সীমানার বাইরে হবে না। পক্ষান্তরে যদি আয়াতে একথা বোঝানো হয়ে থাকে যে, হাশরের হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহি থেকে পলায়ন অসম্ভব, তবে এর কার্যত উপায় কোরআন পাকের অন্যান্য আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, কিয়ামতের দিনে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে সব ফেরেশতা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এসে যাবে এবং মানব ও জিনকে চতুর্দিক থেকে অবরোধ করে নেবে। কিয়ামতের ভয়াবহ কাণ্ড দেখে মানব ও জিন বিভিন্ন দিকে ছুটাছুটি করবে। অতঃপর চতুর্দিকে ফেরেশতাদের অবরোধ দেখে তারা স্বস্থানে ফিরে আসবে। ---(রাহুল মা’আনী)
কৃত্রিম উপগ্রহ ও রকেটের সাহায্যে মহাশূন্য যাত্রার কোন সম্পর্ক এই আয়াতের সাথে নেইঃ বর্তমান যুগে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সীমানা অতিক্রম করার এবং রকেটে চড়ে মহাশূন্যে পৌঁছার ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসব পরীক্ষা আকাশের সীমানার বাইরে নয়। বরং আকাশের ছাদের অনেক নীচে হচ্ছে। এর সাথে আকাশের সীমানা অতিক্রম করার কোন সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞানীরা তো আকাশের সীমানার কাছেও পৌঁছতে পারে না বাইরে যাওয়া দূরের কথা। কোন কোন সরলপ্রাণ মানুষ মহাশূন্য যাত্রার সম্ভাব্যতা ও বৈধতার পক্ষে এই আয়াতকেই পেশ করতে থাকে—এটা কোরআন সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রমাণ।
يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِنْ نَارٍ وَنُحَاسٌ فَلَا تَنْتَصِرَانِ
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) ও অন্যান্য তফসীরবিদ বলেন : ধূম্রবিহীন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হবে شُوَاظٌ এবং অগ্নিবিহীন ধূম্রকুঞ্জকে نُحَاسٌ বলা হয়। এই আয়াতেও জিন ও মানবকে সম্বোধন করে তাদের প্রতি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধূম্রকুঞ্জ ছাড়ার কথা বর্ণনা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য এরাপও হতে পারে যে, হিসাব-নিকাশের পর জাহান্নামে অপরাধীদেরকে দুই প্রকার আযাব দেওয়া হবে। কোথাও ধূম্রবিহীন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হবে এবং কোথাও অগ্নিবিহীন ধুম্রকুঞ্জ হবে। কোন কোন তফসীরবিদ এই আয়াতকে পূর্ববর্তী আয়াতের পরিশিষ্ট ধরে নিয়ে এরূপ অর্থ করেছেন যে, হে জিন ও মানব! আকাশের সীমানা অতিক্রম করার সাধ্য তোমাদের নেই। তোমরা যদি এরূপ করতেও চাও, তাবে যেদিকেই পালাতে চাইবে, সেদিকেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধূম্রকুঞ্জ তোমাদেরকে ঘিরে ফেলবে। -(ইবনে কাসীর)
فَلَا تَنْتَصِرَانِ
এটা انصار থেকে উদ্ভুত। অর্থ কাউকে সাহায্য করে বিপদ থেকে উদ্ধার করা। অর্থাৎ আল্লাহর আযাব থেকে আত্মরক্ষার জন্য জিন ও মানবের মধ্য থেকে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবে না।
فَيَوْمَئِذٍ لَا يُسْأَلُ عَنْ ذَنْبِهِ إِنْسٌ وَلَا جَانٌّ
অর্থাৎ সেদিন কোন মানব অথবা জিনকে তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে না। এর এক অর্থ তফসীরের সার-সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদেরকে কিয়ামতে এই প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক গোনাহ্ করেছ কি না? এ কথা তো ফেরেশতাদের লিখিত আমলনামায় এবং আল্লাহ্ তা’আলার আদি জ্ঞানে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। বরং প্রশ্ন এই হবে যে, তোমরা অমুক গোনাহ কেন করলে? হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এই তফসীর করেছেন। মুজাহিদ বলেন: অপরাধীদের শাস্তিদানে আদিষ্ট ফেরেশতাগণ অপরাধীদেরকে জিজ্ঞাসা করবে না যে, তোমরা এই গোনাহ্ করেছ কিনা? এর প্রয়োজনই হবে না। কেননা, প্রত্যেক গোনাহের একটি বিশেষ চিহ্ন অপরাধীদের চেহারায় ফুটে উঠবে। ফেরেশতাগণ এই চিহ্ন দেখে তাদেরকে জাহান্নামে ঠেলে দেবে। পরবর্তী يُعْرَفُ الْمُجْرِمُونَ আয়াতে এই বিষয়বস্তু বিধৃত হয়েছে। উপরোক্ত উভয় তফসীরের সারমর্ম এই যে, হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশের পর অপরাধীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার ফয়সালার পর এই ঘটনা ঘটবে। সুতরাং তখন তাদের গোনাহ্ সম্পর্কে কোন আলোচনা হবে না। তারা আলামত দ্বারা চিহ্নিত হয়েই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
হযরত কাতাদাহ (রা) বলেন: এটা তখনকার অবস্থা যখন একবার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে যাবে এবং অপরাধীরা অস্বীকার করবে ও কসম খাবে। তখন তাদের মুখে মোহর মেরে দেওয়া হবে এবং হস্তপদের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। ইবনে কাসীর বণিত এই তিনটি তফসীর কাছাকাছি। এগুলোর মধ্যে কোন বিরোধ নেই।
سِيمَا - يُعْرَفُ الْمُجْرِمُونَ بِسِيمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَالْأَقْدَامِ
শব্দের অর্থ আলামত চিহ্ন। হযরত হাসান বসরী (র) বলেন: সেদিন অপরাধীদের আলামত হবে এই যে, তাদের মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণ ঐ চক্ষু নীলাভ হবে। দুঃখ ও কষ্টের কারণে চেহারা বিষন্ন হবে। এই আলামতের সাহায্যে ফেরেশতারা তাদেরকে পাকড়াও করবে।
نوَاصِي
শব্দটি ناصية এর বহুবচন। অর্থ কপালের চুল। কেশাগ্র ও পা ধরার এক অর্থ এই যে, কারও কেশাগ্র ধরে এবং কারও পা ধরে টানা হবে অথবা এক সময় এভাবে এবং অন্য সময় অন্যভাবে টানা হবে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, কেশাগ্র ও গা এক সাথে বেঁধে দেওয়া হবে।
See More..................

0 Comments