সূরা আর রহমান ( আয়াত নং - ২৫ এর তাফসীর )
فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ
মুফতী তাকী উসমানী
সুতরাং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নি‘আমতকে অস্বীকার করবে?
তাফসীরে মাআ’রিফুল কুরআনঃ
সুরার যোগসূত্র এবং فباى الاء বাক্যটি বারবার উল্লেখ করার তাৎপর্য: পূর্ববর্তী সূরা ক্বামারের অধিকাংশ বিষয়বস্তু অবাধ্য জাতিসমূহের শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছিল। তাই প্রত্যেক শাস্তির পর মানুষকে হুঁশিয়ার করার জন্য فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ বাক্যটি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। এর সাথে সাথে ঈমান ও আনুগত্যে উৎসাহিত করার জন্য দ্বিতীয় বাক্য وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ কে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিপরীতে সূরা রহমানের বেশীর ভাগ বিষয়বস্তু আল্লাহ্ তা’আলার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অবদানসমূহের বর্ণনা সম্পর্কিত। তাই যখন কোন বিশেষ অবদান উল্লেখ করা হয়েছে, তখনই মানুষকে হুঁশিয়ার ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারে উৎসাহিত করার জন্য فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ বাক্যটি বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। সমগ্র সূরায় এই বাক্য একত্রিশ বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্যেক বার বাক্যটি নতুন নতুন বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে এটা অলংকার শাস্ত্রের পরিপন্থী নয়। আল্লামা সুয়ূতী এ ধরনের পুনরুল্লেখের নাম রেখেছেন তরদীদ। এটা বিশুদ্ধভাষী আরবদের গদ্য ও পদ্য রচনায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রশংসিত। শুধু আরবী ভাষাই নয়, ফারসী, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় সর্বজনস্বীকৃত কবিদের কাব্যেও এর নযীর পাওয়া যায়। এসব নযীর উদ্ধৃত করার স্থান এটা নয়। তফসীর রাহুল-মা’আনীতে এ স্থলে কয়েকটি নযীর উল্লেখ করা হয়েছে।
করুণাময় আল্লাহ্ (তাঁর অসংখ্য অবদান আছে। তন্মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক অবদান এই যে, তিনি) কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন (অর্থাৎ বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য এবং ইলম হাসিল করে আমল করার জন্য কোরআন নাযিল করেছেন, যাতে বান্দারা চিরস্থায়ী সুখ ও আরাম, হাসিল করে। আরেকটি শারীরিক অবদান এই যে, তিনি) সৃষ্টি করেছেন মানুষ, (অতঃপর) তাকে শিখিয়েছেন বিবৃতি (এর উপকারিতা হাজারো। অন্যের মুখ থেকে কোরআন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া তন্মধ্যে একটি। আরেকটি বিশ্বজনীন দৈহিক অবদান এই যে, তাঁর আদেশে ) সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমত চলে এবং তৃণলতা ও বৃক্ষাদি। (আল্লাহর) অনুগত। সূর্য ও চন্দ্রের গতি দ্বারা দিবা-রাত্র, শীত-গ্রীষ্ম এবং মাস ও বছরের হিসাব জানা যায়। কাজেই তা অবদান। (আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের জন্য বৃক্ষাদির মধ্যে অসংখ্য উপকার সৃষ্টি করেছেন। কাজেই বৃক্ষের আনুগত্যও এক অবদান। আরেক অবদান এই যে) তিনিই আকাশকে সমুন্নত করেছেন। (নভোমণ্ডলীয় উপকারিতা ছাড়াও এর একটা বড় উপকার এই যে, একে দেখে স্রষ্টার অপরিসীম মাহাত্ম্য অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ্ বলেনঃ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ আরেক অবদানএই যে, তিনিই (দুনিয়াতে) দাড়ি-পাল্লা স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ওজনে কমবেশী না কর। (এটা যখন লেনদেনের হক পূর্ণ করার একটি যন্ত্র, যদ্বারা হাজারো বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অনিষ্ট দূর হয় তখন তোমরা বিশেষভাবে এই অবদানের কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর এবং এটাও এক কৃতজ্ঞতা যে ) তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম দিয়ো না। (আরেক অবদান এই যে) তিনিই সৃষ্ট জীবের জন্য পৃথিবীকে (তার স্থানে) স্থাপন করেছেন। এতে আছে ফলমূল এবং বহিরাবরণ বিশিষ্ট খজুর বৃক্ষ। আর আছে খোসা বিশিষ্ট শস্য ও সুগন্ধ ফুল অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (অর্থাৎ অস্বীকার করা খুবই হঠকারিতা এবং জাজ্বল্যমান বিষয়সমূহকে অস্বীকার করার নামান্তর। আরেক অবদান এই যে ) তিনিই মানুষকে (অর্থাৎ তাদের আদি পুরুষ আদমকে) সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে (অর্থাৎ তাদের আদি পুরুষকে) সৃষ্টি করেছেন খাঁটি অগ্নি থেকে (যাতে ধূম্র ছিল না। অতঃপর প্রজননের মাধ্যমে উভয় জাতি বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে)। অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালন কর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? তিনি দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের মালিক। (দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের অর্থ সূর্য ও চন্দ্রের দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচল। দিবা-রাত্রির শুরু ও শেষের উপকারিতা এর সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই এটাও একটা অবদান। অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (আরেক অবদান এই যে) তিনি দুই দরিয়াকে (দৃশ্যত) মিলিত করেছেন, ফলে (বাহ্যত) সংযুক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু (প্রকৃতপক্ষে ) উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক (প্রাকৃতিক) অন্তরাল, যা তারা (অর্থাৎ উভয় দরিয়া) অতিক্রম করতে পারে না। (লবণাক্ত পানি ও মিষ্ট পানির উপকারিতা অজানা নয়। দুই দরিয়া সংযুক্ত হওয়ার মধ্যে প্রমাণগত অবদানও আছে)। অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (দুই দরিয়া সম্পর্কিত এক অবদান এই যে) উভয় দরিয়া থেকে মোতি ও প্রবাল উৎপন্ন হয়। এগুলোর উপকারিতা ও অবদান হওয়া বর্ণনা সাপেক্ষ নয়)। অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? (আরেক অবদান এই যে) তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন ( ও মালিকানাধীন) সেই জাহাজসমূহ যেগুলো সমুদ্রে পর্বত সদৃশ ভাসমান (দৃষ্টিগোচর হয়। এগুলোর উপকারিতাও দিবালোকের মত সুস্পষ্ট)। অতএব (হে জিন ও মানব) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার (এত অধিক অবদানের মধ্য থেকে) কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে?
সূরা আর-রহমান মক্কায় অবতীর্ণ, না মদীনায় অবতীর্ণ এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কুরতুবী কতিপয় হাদীসের ভিত্তিতে মক্কায় অবতীর্ণ হওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিরমিযীতে হযরত জাবের (রা) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ্ (সা) কয়েকজন লোকের সামনে সমগ্র সূরা আর-রহমান তিলাওয়াত করেন। তাঁরা শুনে নিশ্চুপ থাকলে রসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ আমি ’লায়লাতুল জিনে’ (জিন-রজনীতে) জিনদের সামনে এই সূরা তিলাওয়াত করেছিলাম। প্রভাবান্বিত হওয়ার দিক দিয়ে তারা তোমাদের চেয়ে উত্তম ছিল। কারণ, আমি যখনই সূরার فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ আয়াতটি তিলাওয়াত করতাম, তখনই তারা সমস্বরে
বলে উঠতঃ ربنا لا نكذب بشيء من نعمك فلك الحمد অর্থাৎ হে আমাদের পালনকর্তা। আমরা আপনার কোন অবদানকেই অস্বীকার করব না। আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। এই হাদীস থেকে জানা যায় যে, সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। কেননা, ’জিন-রজনীর’ ঘটনা মক্কায় সংঘটিত হয়েছিল। এই রজনীতে রসূলুল্লাহ্ (সা) জিনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। এবং তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা দান করেছিলেন।
কুরতুবী এ ধরনের আরও কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। সব হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরাটিকে ’রহমান’ শব্দ দ্বারা শুরু করার তাৎপর্য এই যে, মক্কার কাফিররা আল্লাহ্ তা’আলার এই নাম সম্পর্কে অবগত ছিল না। তাই মুসলমানদের মুখে ’রহমান’ নাম শুনে তারা বলাবলি করতঃ وما الرَّحْمَنُ রহমান আবার কি? তাদেরকে অবহিত করার জন্য এখানে এই নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ এই যে, পরের আয়াতে কোরআন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কাজেই ‘রহমান’ শব্দটি ব্যবহার করে একথাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এই কোরআন শিক্ষা দেওয়ার কার্যকরী কারণ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার রহমত ও করুণা। নতুবা তাঁর দায়িত্বে কোন কাজ ওয়াজিব বা জরুরী নয় এবং তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন।
এরপর সমগ্র সূরায় আল্লাহ্ তা’আলার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অবদানসমূহের অব্যাহত বর্ণনা রয়েছে । عَلَّمَ الْقُرْآنَ বলে সর্ববৃহৎ অবদান দ্বারা শুরু করা হয়েছে। কোরআন সর্ববৃহৎ অবদান। কেননা, এতে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় প্রকার কল্যাণ রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম কোরআনকে কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করেছেন এবং এর প্রতি যথার্থ মর্যাদা প্রদর্শন করেছেন। ফলে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদেরকে পরকালীন উচ্চ মর্যাদা ও নিয়ামত দ্বারা গৌরবান্বিত করেছেন এবং দুনিয়াতেও এমন উচ্চ আসন দান করেছেন, যা রাজা-বাদশাহরাও হাসিল করতে পারে না।
ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী عَلَّمَ ক্রিয়াপদের দুটি কর্ম থাকে——এক. যা শিক্ষা দেওয়া হয় এবং দুই যাকে শিক্ষা দেওয়া হয়। আয়াতে প্রথম কর্ম উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোরআন। কিন্তু দ্বিতীয় কর্ম অর্থাৎ কাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। কোন কোন তফসীরবিদ বলেনঃ এখানে রসূলুল্লাহ (সা) উদ্দেশ্য। কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যক্ষভাবে তাঁকেই শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর তাঁর মধ্যস্থতায় সমগ্র সৃষ্ট জীব এতে দাখিল রয়েছে। এরূপও হতে পারে যে, কোরআন নাযিল করার লক্ষ্য সমগ্র সৃষ্ট জগতকে পথপ্রদর্শন করা ও তাদেরকে নৈতিক চরিত্র ও সৎ কর্ম শিক্ষা দেওয়া। এই ব্যাপকতার দিকে ইঙ্গিত করার জন্যই আয়াতে বিশেষ কোন কর্ম উল্লেখ করা হয়নি।
خَلَقَ الْإِنْسَانَ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
মানব সৃষ্টি আল্লাহ, তা’আলার একটি বড় অবদান। স্বাভাবিক ব্রুম অনুসারে এটাই সর্বাগ্রে। কোরআন শিক্ষা দেওয়ার অবদানটি মানব সৃষ্টির পরেই হতে পারে। কিন্তু কোরআন পাক এই অবদান অগ্রে এবং মানব সৃষ্টি পরে উল্লেখ করেছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানব সৃষ্টির আসল লক্ষ্যই হচ্ছে কোরআন শিক্ষা এবং কোরআন নির্দেশিত পথে চলা। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ অর্থাৎ আমি জিন ও মানবকে শুধু আমার ইবাদত করার জন্য করেছি। বলা বাহুল্য, আল্লাহর শিক্ষা বাতীত ইবাদত হতে পারে না। কোরআন এই শিক্ষার উপায়। অতএব এই দিক দিয়ে কোরআন শিক্ষা মানব সৃষ্টির অগ্রে স্থান লাভ করেছে।
মানব সৃষ্টির পর অসংখ্য অবদান মানবকে দান করা হয়েছে। তন্মধ্যে এখানে বিশেষভাবে বর্ণনা শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মনে হয় এর তাৎপর্য এই যে, মানুষের ক্রমবিকাশ, অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের সাথে যেসব অবদান সম্পর্কযুক্ত। যেমন পানাহার, শীত ও গ্রীষ্ম থেকে আত্মরক্ষার উপকরণ, বসবাসের ব্যবস্থা ইত্যাদিতে মানব ও জন্তু জানোয়ার নির্বিশেষে প্রাণীমাত্রই অংশীদার। কিন্তু যেসব অবদান বিশেষভাবে মানুষের সাথে সম্পৃক্ত, সেগুলোর মধ্যে প্রথমে কোরআন শিক্ষা ও পরে বর্ণনা শিক্ষার উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, কোরআন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া বর্ণনাশক্তির উপরই নির্ভরশীল।
এখানে বর্ণনার অর্থ ব্যাপক। মৌখিক বর্ণনা, লেখা ও চিঠিপত্রের মাধ্যমে বর্ণনা এবং অপরকে বোঝানোর যত উপায় আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন, সবই এর অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন ভূখণ্ড ও বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ভাষা ও বাকপদ্ধতি সবই এই বর্ণনা শিক্ষার বিভিন্ন অঙ্গ এবং এটা কার্যত وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا আয়াতের তফসীরও।
الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ
আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের জন্য ভূমণ্ডলে ও নভোমণ্ডলে অসংখ্য অবদান সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতে নভোমণ্ডলীয় অবদানসমূহের মধ্য থেকে বিশেষভাবে সূর্য ও চন্দ্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, বিশ্ব-জগতের গোটা ব্যবস্থাপনা এই দু’টি গ্রহের গতি ও কিরণ-রশ্মির সাথে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে। حُسْبَانٍ শব্দটি কারও কারও মতে ধাতু। এর অর্থ হিসাব। কেউ কেউ বলেন যে, এটা حساب শব্দের বহুবচন। আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, সূর্য ও চন্দ্রের গতি এবং কক্ষপথে বিচরণের অটল ব্যবস্থা একটি বিশেষ হিসাব ও পরিমাপ অনুযায়ী চালু রয়েছে। সূর্য ও চন্দ্রের গতির উপরই মানব জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার নির্ভর করে। এর মাধ্যমেই দিবারাত্রির পার্থক্য, ঋতু পরিবর্তন এবং মাস ও বছর নির্ধারিত হয়। حُسْبَانٍ শব্দটিকে حساب এর বহুবচন ধরা হলে অর্থ এই হবে যে, সূর্য ও চন্দ্র প্রত্যেকের পরিক্রমণের আলাদা আলাদা হিসাব আছে। বিভিন্ন ধরনের হিসাবের উপর সৌর ও চান্দ্র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এসব হিসাবও এমন অটল ও অনড় যে, লাখো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এতে এক মিনিট বা এক সেকেণ্ডেরও পার্থক্য হয়নি।
বর্তমান যুগকে বিজ্ঞানের উন্নতির যুগ বলা হয়। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর নব নব আবিষ্কার প্রত্যেকটি বুদ্ধিমান মানুষকে হতবুদ্ধি করে রেখেছে। কিন্তু মানবাবিষ্কৃত বস্তু ও আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য প্রত্যেকেরই চোখে পড়ে। মানবাবিষ্কৃত বস্তুর মধ্যে ভাঙ্গাগড়া এক অপরিহার্য বিষয়। মেশিন যতই মজবুত ও শক্ত হোক না কেন কিছু দিন পর তা মেরামত করা, কমপক্ষে কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা জরুরী হয়ে পড়ে। মেরামত ও পরিচ্ছন্নকরণের সময়ে মেশিনটি অকেজো থাকে। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার প্রবর্তিত এই বিশালকায় গ্রহগুলো কোন সময় মেরামতের মুখাপেক্ষী হয় না এবং এদের অব্যাহত গতিধারায় কোন পার্থক্যও হয় না।
وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ
কাণ্ডবিহীন লতানো গাছকে نجم এবং কাণ্ডবিশিষ্ট বৃক্ষকে شجر বলা হয়। অর্থাৎ সর্বপ্রকার লতাপাতা ও বৃক্ষ আল্লাহ্ তা’আলার সামনে সিজদা করে। সিজদা চূড়ান্ত সম্মান প্রদর্শন ও আনুগত্যের লক্ষণ। তাই এখানে উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক বৃক্ষ, লতাপাতা, ফল ও ফুলকে যে যে বিশেষ কাজ ও মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তারা অনবরত সেই কাজ করে যাচ্ছে এবং নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে মানুষের উপকার সাধন করে যাচ্ছে। এই সৃষ্টিজগত ও বাধ্যতা মূলক আনুগত্যকেই আয়াতে ‘সিজদা’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।—(রাহুল-মা’আনী, মাযহারী)
رَفَعَ - وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ ও وَضَعَ
দুটি বিপরীত শব্দ। رَفَعَ শব্দের অর্থ সমুন্নত করা এবং وَضَعَ শব্দের অর্থ নীচে রাখা। আয়াতে প্রথমে আকাশকে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে। স্থানগত উচ্চতা ও মর্যাদাগত উচ্চতা উভয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আকাশের মর্যাদা পৃথিবীর তুলনায় উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। পৃথিবী আকাশের বিপরীত গণ্য হয়। সমগ্র কোরআনে এই বৈপরীত্য সহকারেই আকাশ ও পৃথিবীর উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে আকাশকে সমুন্নত করার কথা বলার পর মীযান স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে, যা আকাশের বিপরীতে আসে না। চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এখানেও প্রকৃতপক্ষে আকাশের বিপরীতে পৃথিবীকে আনা হয়েছে। তিন আয়াতের পর বলা হয়েছে وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلْأَنَامِ কাজেই আসলে আকাশ ও পৃথিবীর বৈপরীত্যই ফুটানো হয়েছে। কিন্তু বিশেষ রহস্যের কারণে উভয়ের মাঝখানে তৃতীয় একটি বিষয় অর্থাৎ মীযান স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। মনে হয় এতে রহস্য এই যে, মীযান স্থাপন এবং পরবর্তী তিন আয়াতে বর্ণিত মীযানকে যথাযথ ব্যবহার করার নির্দেশ, এতদুভয়ের সারমর্ম হচ্ছে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আত্মসাৎ ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা। এখানে আকাশকে সমুন্নতকরণ ও পৃথিবী স্থাপনের মাঝখানে মীযানের কথা উল্লেখ করায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্যও ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। পৃথিবীতে শান্তিও ন্যায় এবং ইনসাফের মাধ্যমেই কায়েম থাকতে পারে। নতুবা অনর্থই অনর্থ হবে।
হযরত কাতাদাহ্, মুজাহিদ, সুদ্দী প্রমুখ ’মীযান’ শব্দের তফসীর করেছেন ন্যায় বিচার। কেননা, মীযান তথা দাঁড়িপাল্লার আসল লক্ষ্য ন্যায়বিচারই। তবে মীযানের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে দাঁড়িপাল্লা। কোন কোন তফসীরবিদ মীযানকে এই অর্থেই নিয়েছেন। এর সারমর্মও পারস্পরিক লেনদেনে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করা। এখানে মীযানের অর্থে এমন যন্ত্র দাখিল আছে, যদ্দ্বারা কোন বস্তুর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। তা দুই পাল্লা বিশিষ্ট হোক কিংবা কোন আধুনিক পরিমাপযন্ত্র হোক।
أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ
এই আয়াতে দাঁড়িপাল্লা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ওজনে কমবেশী করে জুলুম ও অত্যাচারে লিপ্ত না হও।
وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ
অর্থাৎ ইনসাফ সহকারে ন্যায্য ওজন কায়েম কর। قِسْط-এর শাব্দিক অর্থ ইনসাফ।
وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ - وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ
বাক্যে যে বিষয়টি ধনাত্মক ভঙ্গিতে ব্যক্ত করা হয়েছে, এই বাক্যে তাই ঋণাত্মক ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ওজনে কম দেওয়া হারাম।
وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلْأَنَامِ
ভূপৃষ্ঠের প্রত্যেক প্রাণীকে أَنَام বলা হয়।—(কামুস)
বায়যাভী বলেন : যার আত্মা আছে, সেই —আয়াতে أَنَام বলে বাহ্যত মানব ও জিনকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, যাদের আত্মা আছে, তাদের মধ্যে এই দুই শ্রেণীই শরীয়তের বিধি-বিধানের আওতাভুক্ত। এই সূরায় فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا বলে তাদেরকে বারবার সম্বোধনও করা হয়েছে।
فَاكِهَةٌ - فِيهَا فَاكِهَةٌ
এমন ফলমূলকে বলা হয়, যা আহারের পর স্বভাবত মুখের স্বাদ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে খাওয়া হয়।
أَكْمَامِ - وَالنَّخْلُ ذَاتُ الْأَكْمَامِ
শব্দটি كم-এর বহুবচন। এর অর্থ সেই বহিরাবরণ, যা খজুর ইত্যাদি ফলগুচ্ছের উপরে থাকে।
حب - وَالْحَبُّ ذُو الْعَصْفِ
এর অর্থ শস্য। যেমন গম, বুট, ধান, মাষ, মসুর ইত্যাদি। সেই খোসাকে বলে, যার ভেতরে আল্লাহর কুদরতে মোড়কবিশিষ্ট অবস্থায় শস্যের দানা সৃষ্টি করা হয়। এই খোসার আবরণে মোড়কবিশিষ্ট হওয়ার কারণে শস্যের দানা দূষিত আবহাওয়া ও পোকা-মাকড় ইত্যাদি থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। শস্যের দানার সাথে ’খোসাবিশিষ্ট’ কথাটি যোগ করে বুদ্ধিমান মানুষের দৃষ্টি এ দিকে আকৃষ্ট করা হয়েছে যে, তোমরা যে রুটি, ডাল ইত্যাদি প্রত্যহ কয়েকবার আহার কর, এর এক একটি দানাকে সৃষ্টিকর্তা কিরূপ সুকৌশলে মৃত্তিকা ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এরপর কিভাবে একে কীট-পতঙ্গ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য আবরণ দ্বারা আবৃত করেছেন। এত কিছুর পরই সেই দানা তোমাদের মুখের গ্রাসে পরিণত হয়েছে। এর সাথে সম্ভবত আরও একটি অবদানের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এই খোসা তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুর খোরাক হয়, যাদের দুধ তোমরা পান কর এবং যাদেরকে বোঝা বহনের কাজে নিয়োজিত কর।
وَالرَّيْحَانُ
এর প্রসিদ্ধ অর্থ সুগন্ধি। ইবনে যায়েদ (র) আয়াতের এই অর্থই বুঝিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’আলা মৃত্তিকা থেকে উৎপন্ন বৃক্ষ থেকে নানা রকমের সুগন্ধি এবং সুগন্ধযুক্ত ফুল সৃষ্টি করেছেন। ريْحَان শব্দটি কোন কোন সময় নির্যাস ও রিযিকের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। বলা হয় خرجت أطلب ريحان الله অর্থাৎ আমি আল্লাহর রিযিক অন্বেষণে বের হলাম। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) আয়াতে ريحان এর এ তফসীরই করেছেন।
آلَاءِ - فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
শব্দটি বহুবচন। এর অর্থ অবদান। আয়াতে জিন ও মানবকে সম্বোধন করা হয়েছে। সূরা আর-রহমানের একাধিক আয়াতে জিনদের আলোচনা থেকে একথা বোঝা যায়।
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ
এখানে إِنْسَانَ বলে সরাসরি মৃত্তিকা থেকে সৃষ্ট আদম (আ)-কে বোঝানো হয়েছে। صَلْصَال -এর অর্থ পানি মিশ্রিত শুষ্ক মাটি।فَخَّارِ -এর অর্থ পোড়ামাটি। অর্থাৎ মানুষকে পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছেন।
جَانّ - وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ
এর অর্থ জিন জাতি। مَارِج-এর অর্থ অগ্নিশিখা। জিন সৃষ্টির প্রধান উপাদান অগ্নিশিখা, যেমন মানব সৃষ্টির প্রধান উপাদান মৃত্তিকা।
رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ
শীত ও গ্রীষ্মকালে সূর্যের উদয়াচল ও অস্তাচল পরিবর্তিত হয়। শীতকালে مَشْرِقَ অর্থাৎ উদয়াচল এবং مَغْرِبَ অর্থাৎ অস্তাচল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় হয়। আয়াতে সম্বৎসরের এই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলকে مَشْرِقَيْنِ ও مَغْرِبَيْنِ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
مَرَج - مَرَجَ الْبَحْرَيْن
এর আভিধানিক অর্থ স্বাধীন ও মুক্ত ছেড়ে দেওয়া এই বলে মিঠা ও লোনা দুই দরিয়া বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবীতে উভয় প্রকার দরিয়া সৃষ্টি করেছেন। কোন কোন স্থানে উভয় দরিয়া একত্রে মিলিত হয়ে যায়, যার নযীর পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু যে স্থানে মিঠা ও লোনা উভয় প্রকার দরিয়া পাশাপাশি প্রবাহিত হয়, সেখানে বেশ দূর পর্যন্ত উভয়ের পানি আলাদা ও স্বতন্ত্র থাকে। একদিকে থাকে মিঠা পানি এবং অপরদিকে লোনা পানি। কোথাও কোথাও এই মিঠা ও লোনা পানি উপরে-নীচেও প্রবাহিত হয়। পানি তরল ও সূক্ষ্ম পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে মিশ্রিত হয় না। আল্লাহ তা’আলার এই অপার শক্তি প্রকাশ করার জন্যই বলা হয়েছে :مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَا يَبْغِيَانِ অর্থাৎ উভয় দরিয়া পরস্পরে মিলিত হয়। কিন্তু উভয়ের মাঝখানে আল্লাহর কুদরতের একটি অন্তরাল থাকে, যা দূর পর্যন্ত তাদেরকে মিশ্রিত হতে দেয় না।
لُّؤْلُؤُ - يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ
শব্দের অর্থ মোতি এবং مَرْجَانُ এর অর্থ প্রবাল। এটাও মূল্যবান মণিমুক্তা। এতে বৃক্ষের ন্যায় শাখা হয়। এই মোতি ও প্রবাল সমুদ্র থেকে বের হয়। কিন্তু প্রসিদ্ধ এই যে, মোতি ও মণিমুক্তা লোনা সমুদ্র থেকে বের হয়— মিঠা সমুদ্র নয়। আয়াতে উভয় প্রকার সমুদ্র থেকে বের হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর জওয়াব এই যে, মোতি উভয় প্রকার সমুদ্রেই উৎপন্ন হয়। কিন্তু মিঠা পানির সমুদ্র প্রবহমান হওয়ার কারণে তা থেকে মোতি বের করা সহজসাধ্য নয়। মিঠা পানির সমুদ্র প্রবাহিত হয়ে লোনা সমুদ্রে পতিত হয় এবং সেখান থেকেই মোতি বের করা হয়। এ কারণেই লোনা সমুদ্রকে মোতির উৎস বলা হয়ে থাকে।ا
جَوَارِى - وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَآتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ
শব্দটি جارية বহুবচন। এর এক অর্থ নৌকা, জাহাজ। এখানে তাই বোঝানো হয়েছে। مُنْشَآتُ শব্দটি نشا থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ ভেসে উঠা, উঁচু হওয়া অর্থে এখানে নৌকার পাল বোঝানো হয়েছে, যা পতাকার ন্যায় উঁচু হয়। আয়াতে নৌকার নির্মাণ কৌশল ও পানির উপর বিচরণ করার রহস্য বর্ণনা করা হয়েছে।
See More.......

0 Comments